সোমবার, ৩১ মার্চ, ২০১৪

এক লোহিত গ্রহের জন্য নীল




দাদুকে খুব পছন্দ করে অয়ন। দাদু মজার মজার গল্প বলেন। যখন দুষ্টুমি করতে গিয়ে বাবা মার হাতে বকা খায় তখন দাদুই ওকে বাঁচান। দাদু ছয় ফুট ইঞ্চি লম্বা। এই ৭৫ বছর বয়সেও স্বাচ্ছন্দ্যে চলাচল করতে পারেন। তা তো হবেই। কারণ দাদু ছিলেন বিমানবাহিনীতে। ছিলেন এক জন মহাকাশচারী। দাদুকে নিয়ে অয়নের গর্ব। মঙ্গল গ্রহে পা দেওয়া প্রথম মানুষদের একজন তার দাদু। এখনও তার কাছে রিপোর্টাররা আসেন। কয়েক দিন যখন কেপলার ২২বি তে মানুষ অবতরণ করে তখন টেলিভিশনে একটা টক শোতে যান দাদু। নিজে এই প্রথম সরাসরি দাদুকে দেখে যা খুশি হয়েছিল না অয়ন।
কিন্তু একটা জিনিস অয়নের কাছে অবাক লাগে। মঙ্গল গ্রহ অভিযানের কাহিনি শোনাতে চাইলে দাদু কেমন জানি হয়ে যান। বলতে রাজি হন না। দিক দিক ঘুরিয়ে দেন কথা। মনে হয় কিছু একটা স্মৃতি কষ্ট দেয় দাদুকে। অয়ন পড়েছে মঙ্গল গ্রহ অভিযানে তার দাদু সহ জন যান। কিন্তু একজন মারা যান। কেন একু বলতে পারে নাই। তার মৃতদেহ পাওয়া যায় নাই। এই স্মৃতিই কি দাদুকে কষ্ট দেয়?
সে দিন স্কুল থেকে ফিরেই দাদুকে ধরল অয়ন। দাদু তখন বরাবরের মত উপেক্ষা করার চেষ্টা করেন। কিন্তু এবার অয়ন নাছোড়বান্দা। সে দাদুকে ছাড়বেই না। অবশেষে নাতির কাছে পরাস্ত হলেন এক কালের পরম পরাক্রমশালী মহাকাশচারী এয়ার ভাইস মার্শাল ( অব.) তন্ময় কুমার সাহা। নাতিকে বললেন, “দাদুভাই, তুমি খেয়ে আস। আমি আজ তোমাকে সব বলব। মনের সব কষ্টের কথা আজ খুলে বলব তোমাকে। কিন্তু একটা কথা দিতে হবে। এই কথা কাউকে বলেব না। রাজি?”
অয়ন খুশীতে ডগমগ করতে করতে বলল, “দাদু রাজি।
িক আছে। তুমি খেয়ে আসো।
এক ছুটে ডাইনিং গিয়ে গোগ্রাসে কিছু গিলে ফিরে এল অয়ন। তার তড় সইছে না। দাদুর মঙ্গল যাত্রার গল্প শুনবে।
দাদু একটা পান মুখে দিলেন। পান খেতে খুব পছন্দ করেন দাদু। এরপর গল্প বলা শুরু করলেন।
াদুভাই, তখন আমি যুবক। বিমানবাহিনী থেকে কমিশন পেয়েছি। পাইলট অফিসার হিসেবে যোগ দিয়েছিলাম দ্রুত পদোন্নতি পেয়ে স্কোয়াড্রন লিডার পর্যন্ত পৌঁছে গেলাম। রক্ত গরম। তারপর তোমার ঠাকুরমাকে বিয়েও করেছি। তখন শান্তিকালীন সময়। যুদ্ধ নেই। মাঝে মাঝে ফ্লাইটার বিমান নিয়ে উড়ে বেড়াই। বেশ কাটছিল সময়টা। 
এমন সময় প্রস্তাব টা এল। মঙ্গল গ্রহে মানুষ পাঠাতে যাচ্ছে স্পেস কাউন্সিল। তারা বিমানবাহিনী থেকে লোক খুঁজছে। আমার সহ অনেকের নাম দেওয়া হল। তাদের নিয়ে কঠোর প্র্যাকটিস করানো হল। শেষ পর্যন্ত টিকে গেলাম আমি আর আর আমার বন্ধু শেখর কুমার দেবনাথ।
স্পেস কাউন্সিল ঠিক করলো জন কে পাঠাবে। শেষ পর্যন্ত নির্বাচিত জনকে একসাথে করা হল। বিমানবাহিনী থেকে আমি আর শেখর। সেনাবাহিনী থেকে ক্যাপ্টেন আসিফ হোসেন ইউশা এবং ক্যাপ্টেন নাশিদ ফরহাদ। বেসামরিক একজন চান্স পেল রাশিদুল হাসান।
শেখর আমার কলেজ লাইফের বন্ধু। ওকে তো তুমি চিনো। মাঝে মাঝে এখনও বাসায় আসে। যে চিকন করে চুল পাকা দাদুটা
্যাঁ হ্যাঁ িনতে পেরেছি চোখ গোল গোল করে বলল অয়ন। খুব ভালো দাদু। আসলেই আমার জন্য চকলেট নিয়ে আসে।
হেসে ফেললেন দাদু, আবার বলতে শুরু করলেন।
েখর ভূতত্ত্বের ওপর পড়াশুনা করেছে। এই কারণে ওর উপর দায়িত্ব ছিল মঙ্গলের আবহাওয়া আর ভূপ্রকৃতি নিয়ে গবেষণা করা।
আমি ছিলাম জীববিজ্ঞানী। মানে এই বিষয়ের উপর আমার পিএইচডি ছিল। বিমানবাহিনীতে থাকলেও এই বিষয়ের উপর পড়েছিলাম। আমার দায়িত্ব ছিল মঙ্গলে প্রাণ আছে, নাকি কখনও ছিল এই সব বিষয়ে গবেষণা করা।
আসিফ হোসেন ইউশা একজন ডাক্তার। আর্মির মেডিকেল কোরের মেম্বার।
নাশিদ ফরহাদের স্পেসালিটি ছিল মহাকাশ বিজ্ঞানে। ওকে নির্বাচিত করা হয়েছিল স্পেসশিপের কম্যান্ডার হিসেবে। নেতৃত্ব দেওয়ার গুণ ছিল ওর ভিতর।
আর রাশিদুল হাসান ছিল একজন ইঞ্জিনিয়ার। পিএইচডি করেছিল কানাডার ওয়াটার লু ইউনিভার্সিটি থেকে।
অল্প কয়েকদিনের ভিতর আমরা একে অন্যের বন্ধু হয়ে উঠলাম। বয়সের ব্যবধান কাছাকাছি থাকায় নিজের ভাইয়ের মত হয়ে গেলাম। এক সাথে ট্রেনিং করতাম। স্মিমুলেশন, আণ্ডার ওয়াটার ট্রেনিং আরও কত কি। এর পর এল আসল সময়।
আমাদের মহাকাশযান মার্স বোট বা মঙ্গলের জাহাজ রেডি যাত্রা করার জন্য আমরা পরিবারের সাথে দেখা করলাম। কারণ পাড়ি দিতে হবে মোটামুটি দশমিক কোটি থেকে   কোটি কিলোমিটার।   আমাদের মহাকাশযানের তখনকার গতিতে লাগত বছর পৌঁছাতে। মাস থাকতে হবে। এর পর ফিরতে আবার বছর। বাড়ি থেকে এত দূরে। কোন বিপদ হলে কেউ বাঁচাতে আসবে না ছুটে। এটা তো ঢাকা দিল্লীর বিষয় না। এটা পৃথিবী আর মঙ্গলের ব্যাপার। এখানে পৃথিবী থেকে  আলোর পৌঁছাতে সময় লাগে মিনিট। মানে মঙ্গল থেকে আমরা বেতার সংকেত পাঠাতে চাইলে লাগবে মিনিটের মত। এর পরে সাথে সাথে রিসিভ করে সাথে সাথে কেউ ব্যাক করলেও লাগতে পারে আরও মিনিট। মোট মিনিট অপেক্ষা করতে হবে। তার মানে কোন ঝামেলায় পরলে আমাদের মিনিট কমপক্ষে অপেক্ষা করতে হবে উত্তর পেতে। এই সময়সীমাটা জীবন নাশের   কারণ হতে পারে। মঙ্গলে এর আগেও মানুষ নেমেছে এবং ফিরে এসেছে। কিন্তু ফুল স্কেল গবেষণার জন্য এটাই ছিল ফার্স্ট মিশন।
অবশেষে এল সেই কাঙ্ক্ষিত দিন। ২০৩০ সালের জুলাই। মঙ্গলের উদ্দেশ্যে রওনা করল আমাদের মার্স বোট। দেখলাম আস্তে আস্তে বিন্দুসম হয়ে যাচ্ছিল আমাদের পৃথিবী। মহাশূন্যের অসীম কালো শূন্যতায় আমাদের পাড়ি দিতে হচ্ছিল কোটি কিলোমিটার। এই সময়ে কিছু গবেষণা আর পৃথিবীর সাথে কথা বলে কেটে যাচ্ছিল সময়। অবশেষে ২০৩১ সালের জুন আমরা পৌঁছলাম মঙ্গলের কাছাকাছি। দেখলাম সেই লোহিত গ্রহকে যাকে এতদিন ধরে পড়ে আসছি, জেনে আসছি। দেখলাম তার দুই চাঁদ ফেবোস এবং ডিমোসকে। ধীরে ধীরে বড় হয়ে আসছিল মঙ্গল। ফুটে উঠছিল তার ভূপ্রকৃতি। দেখলাম তার সুউচ্চ পর্বত অলিম্পাস মন্সকে। আয়তনে ফ্রান্সের চেয়েও বড় এই পর্বত ১৩ জুন আমরা অবতরণ করলাম মঙ্গলের লৌহসমৃদ্ধ মাটিতে।
সে এক অপার্থিব জগত। পৃথিবীর মানুষ মনে করে মঙ্গলের মাটির রঙ লাল। আসলে তা কমলা। যেন এক কমলা মরুতে অবতরণ করেছে আমাদের এই মহাকাশযান। কমলা হওয়ার কারণ এর কারণ মঙ্গলের পৃষ্ঠতলে প্রচুর পরিমাণে ফেরিক অক্সাইডের উপস্থিতি।  মঙ্গলের বায়ুমণ্ডলীয় চাপ এতোটা কম যে এতে তরল জল থাকা সম্ভব নয়। কিন্তু মঙ্গলে বরফ রয়েছে। এর দুই মেরু সম্পূর্ণ বরফ দ্বারা গঠিত। মজার একটা বিষয় জানো দাদাভাই, মঙ্গলের দক্ষিণ মেরুতে যে পরিমাণ বরফ রয়েছে তা গলিয়ে দিলে সমগ্র গ্রহটি পানিতে ডুবে যাবে এবং এই জলভাগের গভীরতা হবে প্রায় ১১ মিটার। মঙ্গলের নিজস্ব কোন আয়ন্সফিয়ার নেই। ফলে বেতার যোগাযোগের জন্য আমাদের উঁচু টাওয়ার স্থাপন করতে হল। আমরা অস্থায়ী থাকার জায়গা তৈরি করলাম।
আমাদের অবতরণের স্থান ছিল মঙ্গলের বিষুবরেখার কাছাকাছি যাতে মেরুর শীত থেকে রক্ষা পাওয়া যায়। আমরা মঙ্গলের পাতলা বায়ুমণ্ডলের গ্যাস সমূহ  পরীক্ষা করে দেখেছিলাম। সেখানে মাত্র দশমিক ভাগ অক্সিজেন। ৯৫ ভাগের উপর কার্বন ডাই অক্সাইড। এত কম অক্সিজেনের জন্য এখানে প্রাণের বিকাশ সম্ভব নয়। আমরা নান পরীক্ষা করে পৃথিবীতে পাঠাই। বেতারের মাধ্যমে মিশন কন্ট্রোলের সাথে কথা বলি। কিন্তু চাঁদে থাকলে যেভাবে নিরবিচ্ছিন্নভাবে কথা বলা যেত এখানে তা সম্ভব নয়। কারণটা আগেই বলেছি। বেতার বার্তা পৃথিবীতে যেতেই সময় নেয় মিনিট।
মঙ্গলে আমরা পৃথিবীর হিসাবে তিন মাস থাকব। দেড় মাস পর্যন্ত ভালোই কাটছিল  সময়। এমন সময় ঘটলো দুর্ঘটনা।
এক দিন সকালে সবে মাত্র সূর্য  উঠেছে। আমরা তা দেখছি। এক অভূতপূর্ব দৃশ্য। সূর্য উদয় এবং অস্তের সময় মঙ্গলের আকাশ গোলাপীর মত রঙ হয়।  হয়ে যায়। মধ্য দুপুরে লালচে বাদামি কমলার মিশ্রণ হয়ে যায়। সূর্যাস্তের পর আকাশের রঙ নীলচে বেগুনী বর্ণ ধারণ করে। আমাদের আকাশে সূর্যকে যেই আকারে দেখা যায় তার ভাগের ভাগ আকারে দেখা যায়। আমাদের আকাশে সূর্য যে পরিমাণ আলো দেয় তার ৪০% আলো দেয় সূর্য এখানে।  আমরা তা দেখছি এমন সময় বিস্ফোরণের শব্দ শুনলাম। সাথে সাথে তাকালাম উৎসের দিকে। দেখলাম আমাদের মহাকাশযান থেকে ধোঁয়া বের হচ্ছে। ভয়ে বুক শুঁকিয়ে গেল কারণ এই মহাকাশযানের কিছু হলে পৃথিবীতে ফেরা অনিশ্চিত হয়ে পরবে।
আমরা সবাই ছুটে গেলাম। দেখলাম আমাদের মহাকাশযানের জ্বালানী রাখার জায়গাতে বিস্ফোরণ ঘটেছে। সেখানে আগুন ধরে গিয়েছে। আমরা আগুন নিভালাম। কিন্তু ততক্ষণে যা ক্ষতি হবার তা হয়ে গিয়েছে। ৭৫ ভাগ জ্বালানী নষ্ট হয়ে গিয়েছে। এছাড়া মহাকাশযানের কোন ক্ষতি হয় নাই। কিন্তু আমাদের কপালে হাত পড়লো। জ্বালানী ছাড়া পৃথিবীতে ফিরব কিভাবে?
পৃথিবীর সাথে যোগাযোগ করলাম। তারা শান্ত হতে বলল। তারা আশ্বাস দিল সাহায্য করবে। কিন্তু আমরা বুঝলাম তা আমাদের নিছক সান্ত্বনা দেওয়ার জন্য। কোটি কিলোমিটার দূর থেকে কিভাবে সাহায্য করবে? ”
আমাদের পরিবারের সদস্যরা আমাদের সাথে কথা বলছেন। বুঝতে পারলাম মিশন কন্ট্রোল এটি ইচ্ছা করে করছেই। কারণ আমাদের কাছে রসদ মজুদ আছে আর মাসের জন্য। পৃথিবী থেকে উদ্ধারকারী যান পাঠাতেই সময় লাগবে বছরের মত। কিন্তু এখন পৃথিবীর হাতে মঙ্গলে পাঠানোর উপযোগী যান নেই। তাহলে স্বপ্নের মঙ্গল যাত্রার সমাপ্তি কি হবে এই রকম ট্র্যাজেডিতে? আমার বারবার বাসার কথা মনে পড়ছিলো। আমার মা বাবার মুখ ভেসে উঠছিল চোখের সামনে। সদ্য বিবাহ করা স্ত্রীর কোমল চোখজোড়া ভেসে উঠলো। আমার সহযাত্রীরাও তাও ভাবছে নিশ্চয়। এর পরের যাত্রায় মানুষ এসে উদ্ধার করবে আমাদের মৃতদেহ।
এভাবে সাত দিন কেটে গেল। প্রতিদিনিই কাজের পারফর্মেন্সে ভাঁটা পড়ছিলো। এটা কি মৃত্যুর আগমনবার্তা। রাশিদুলকে দেখতাম কাজ ছেড়ে কি নিয়ে পরে আছে। কিন্তু ওকে ঘাঁটাতাম না।
এক দিন সকালে উঠে দেখি রাশিদুল সবাই কে ডাকছে। কি ব্যাপার। সে আমাদের কিছু বলবে নাকি? সবাই তার কাছে গেলাম।
নাটকীয় ভাবে শুরু করলো , “বন্ধুরা এই লোহিত গ্রহ থেকে মুক্তির উপায় আমি পেয়ে গিয়েছি। আমাদের আর কোন ভয় নাই।
আমরা ভূত দেখার মত ওর দিকে তাকিয়ে রইলাম। কি বলে এটা?
ক্যাপ্টেন ফরহাদ তো বলেই বসল, “ দেখ, রাশিদুল তোমার মাথা খারাপ হয়ে গিয়েছে। আমরা সবাই আছি ভয়ে এই সময়ে তুমি ফাজলামি করছ, কেন বলো তো?”
রাশিদুল বলল, “ আমি কি করেছি তা শুনলে আমাকে এভাবে বলতে না ফরহাদ। আমার এত দিনের পরিশ্রম কাজে লেগেছে।
আমি বললাম, “ কি কাজ? ’’
রাশিদুল বলল, “ আসো, আমার সাথে।
আমরা সবাই ওকে অনুসরণ করে ওর তাঁবুতে গেলাম। দেখলাম ফ্রিজের সমান এক বাক্স রয়েছে। তার সাথে অনেক তার পেঁচিয়ে রয়েছে। ইলেকট্রনিক ডিভাইস হবে ওটা।
শেখর সেই দিকে আঙ্গুল তুলে জিজ্ঞাসা করল, “ এটা কি? ”
এটাই সেই যন্ত্র যা আমাদের পৃথিবীতে পৌঁছাতে সাহায্য করবে। বলল রাশিদুল।
আসিফ বলল, “ কিন্তু এটা কি? ”
রাশিদুল বলল, “ এটা আমাদের নতুন পাওয়ার হাউজ!!
আমি বললাম, “ খোলাসা করে বলো।
রাশিদুল শুরু করলো, “  তোমরা তো সবাই আইনস্টাইনের বিখ্যাত E = mc2 সূত্রের কথা জানো।
আমি বললাম, “ হ্যাঁ, কে না জানে? এই সমীকরণটি  শক্তির সাথে ভরের একটি চমৎকার সম্পর্ক নির্দেশ করে। এটি থেকে বোঝা যায় যে, শক্তি এবং ভর আসলে একই মুদ্রার এপিঠ-ওপিঠ।ভর থেকে শক্তি পাওয়া যায় এবং শক্তি থেকেও ভর পাওয়া যেতে পারে।অর্থাৎ শক্তি এবং ভর পরস্পর সমতুল্য।
রাশিদুল হেসে বলল, “ ঠিক বলেছ তন্ময় এই সূত্র অনুসারে m ভরের কোন বস্তুতে সঞ্চিত শক্তির পরিমাণ ভরের সাথে আলোর বেগ(c) এর বর্গের গুনফল এর সমান।অর্থাৎ কেজি ভরের কোন বস্তুতে সঞ্চিত শক্তির পরিমাণ ৯০০০০০০০০০০০০০০০০ জুল। এই অবিশ্বাস্য পরিমাণ শক্তি আমেরিকার মত একটি দেশের কয়েক দিনের বৈদ্যুতিক শক্তির যোগান দিতে পারে!
ফরহাদ বলল, “ভর শক্তিতে রূপান্তরিত হবার সবচাইতে পরিচিত এবং বেদনাদায়ক উদাহরণটি হল হিরোশিমা-নাগাসাকিতে ১৯৪৫ সালের আগস্ট মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ফেলা পারমাণবিক বোমা বিস্ফোরণের ঘটনা।পারমানবিক বোমাতে একটি বড় মৌলের পরমাণুকে(যেমনঃইউরেনিয়াম বা প্লুটোনিয়াম) নিউট্রন দ্বারা আঘাত করে ভেঙ্গে ফেলা হয়।ফলে বড় পরমাণুটি ভেঙ্গে দুইটি নতুন পরমাণুতে বিভক্ত হয় এবং কিছু ভর পরিণত হয় শক্তিতে।
ঠিক বলেছ ফরহাদ বলল রাশিদুল, “কিন্তু নিউক্লিয়ার বোমাতেও অনেক শক্তি অপচয় হয়। সব ভর ওরা ব্যবহার করতে পারে না। আমার এই যন্ত্রটা সেটা পারবে।
াই নাকি?” কণ্ঠে অবিশ্বাস আমাদের।
্যাঁ। আমি এটা আবিষ্কার করেছি। এটা কোন বস্তুর ভর কে শক্তিকে রূপান্তর করতে পারে।
িন্তু কিভাবে?”
এত জটিল পদ্ধতি বুঝতে চেয়ো না। শুধু এটাই বলতে পারি আমার যন্ত্র E = mc2 সমীকরণকে সম্পূর্ণভাবে কাজ লাগাতে পারবে কণ্ঠে আত্মবিশ্বাস রাশিদুল হাসানের।
িন্তু ভর হিসেবে আমরা কি ব্যবহার করব?” জিজ্ঞাসা করলো নাশিদ ফরহাদ।
মঙ্গলের পাথর
রাশিদুল হাসানের কথায় আমরা যেন মনে জোর ফিরে পেলাম। এমন সময় মাথায় একটা ভয়াবহ চিন্তা এল আমার আমাদের মহাকাশযানের বেগ কিভাবে নির্ধারণ করব? সব শক্তি যদি একই সাথে নির্গত হয়?” 
িন্তা নেই। এখানে এনার্জি স্টোরেজের ব্যবস্থা আছে। কিন্তু ৫০% এর বেশি শক্তি সঞ্চয় করতে পারবে না।রাশিদুলের উত্তর।
ার মানে বাকি ৫০% শক্তি যদি সাথে সাথে নির্গত হয় আর আমাদের মহাকাশযানে তা ব্যবহার করা হয় তাহলে গতি হবে সেকেন্ডে ৬০ হাজার কিলোমিটার। আলোর ভাগের এক ভাগ। তাহলে দুর্ঘটনা ঘটার চান্স বেড়ে যাবে। আর এই গতিতে চললে সময়ের প্রহেলিকার শিকার হব আমরা। ফিরে দেখা যাবে ভবিষ্যতে পৌঁছে গিয়েছি। এটা তো হতে দেওয়া যায় নাআমি বললাম।
ক্ষেত্রে মহাকাশযানের বাইরে থেকে গতি নিয়ন্ত্রণ করতে হবে কাউকে। এই গ্রহে বসে।রাশিদুলের সোজা সাপটা জবাব।
ইলেকট্রিক শক খেলাম যেন আমরা। বলে কি।
ছাড়া আর কোন রাস্তা নেই। বিড়বিড় করে বলল আসিফ।
শেখর জিজ্ঞাসা করল, “ কিন্তু কে থাকবে? ”
ফরহাদ বলল , “ টস হোক
রাশিদুল বলল, “ না, আমি থাকব।
রাশিদুল, আমি থাকব আমি বললাম।
রাশিদুল বলল, “ পাগলামি করো না তন্ময়। এই যন্ত্র আমি বানিয়েছি। তাই এর কাজ আমার থেকে আর কেউ বেশি জানে না। তাই তোমরা কেউ এর কাজ বুঝতে পারবে না। আমাকে থাকতে দাও।
গেলে সবাই যাব, মরলে সবাই মরবো।উত্তেজিত হয়ে পড়লো শেখর।
াগলামি করো না। আমাদের এই মিশনে কি পরিমাণ ডাটা কালেক্ট করেছি জানো? এগুলো পৃথিবীতে না নিয়ে গেলে মানবজাতি অনেক জ্ঞান থেকে বঞ্চিত হবে।
শেষমেষ ঠিক হল রাশিদুল মঙ্গলগ্রহে থেকে যাবে। ওকে মাসের রশদ দিয়ে দেওয়া হল। আমরা পৃথিবীতে ফেরার জন্য তৈরি হলাম। শেষবারের মতো বিদায় দিলাম রাশিদুলকে। ওর যন্ত্র স্থাপন করা হল আমাদের মহাকাশযানে।
সে শান্ত। যাওয়ার আগে শুধু বলল, “ আমার পরিবারকে বলো আমি ঠিক আছি এবং আমি ফিরে আসব। আর এই নাও আমার যন্ত্রের ব্লু প্রিন্ট। এটা নিয়ে পৃথিবীর বিজ্ঞানীরা গবেষণা করতে পারবেন।
এই টুকু বলে থামলেন দাদু। চোখের কোণে তার জল। টিস্যু দিয়ে মুছলেন সেটা। এই সময় অয়ন বলল, “ তারপর দাদু?”
দাদু বলতে শুরু করলেন, “ আমাদের ফিরতে আট মাস লেগেছিল। মূলত রাশিদুলের যন্ত্রের ফলে আমাদের মহাকাশযানের গতি অনেক বেড়ে যায়। ততদিনে মঙ্গলের উদ্দেশ্যে দ্বিতীয় মহাকাশযান যাত্রা করেছে। মূলত রাশিদুল কে উদ্ধারেরর জন্য। কিন্তু ওদের পৌঁছাতে সময় লাগে সোয়া এক বছর।
দাদু থামেন। অয়ন বলল, “ তারপর ওনারা ওকে উদ্ধার করে নিয়ে আসেন?”
দাদু উত্তর দিলেন, “ না। ওকে জীবিত অবস্থায় পাওয়া যায় নাই। তিন মাসের রশদ দিয়ে পনের মাস চলা যায় না। বুঝতে পেরেছিল। তার আগেই আত্মহত্যা করে ও।
ওরা পেয়েছিল ওর শেষ কিছু স্মৃতি। ওর আঁকা কিছু ছবি।
অয়ন বলল, “ কি সেই ছবি? ”
দাদু আঙ্গুল তাক করলেন ঘরের এক কোণে। ওর একটা ছবি, আমি অনেক কষ্টে স্পেস কাউন্সিলকে বুঝিয়ে নিয়ে এসেছিলাম। পৃথিবীর সব থেকে সাওহসি এক জন মানুশের স্মৃতিচিহ্ন। যে কিনা আমার প্রাণ বাঁচিয়েছে।
সেই দিকে তাকাল অয়ন। ছোটবেলা থেকেই ছবিটা দেখে আসছে। কিন্তু পিছনের কাহিনী জানে না। একটি গ্রহের ছবি। এক দিকে লাল মাটি ক্যানভাসের আরেক প্রান্তে এসে নীল জলের সাথে মিশে গিয়েছে। এক দিকে ধু ধু মরু, আরেক দিকে সবুজ গাছ। এক দিকে লালচে বেগুনি আকাশ আরেক দিকে নীল আকাশ।  জ্বলজ্বল করছে সূর্যদেব।
লাল গ্রহে বসে রাশিদুল হাসানের আঁকা শেষ ছবি।
দাদু বলতে লাগলেন, “ দাদুভাই, রাশিদুল স্বপ্নের কথা বলত, মঙ্গলে এক দিন জীবিত হবে। সেখানে নীল আকাশ থাকবে। মানুষ গাছ লাগাবে এক দিন। সেটাই এঁকেছে। আমরা ফিরতে না পারলে গবেষণার কাজ আরও ৫০ বছর পিছিয়ে যেত। আমরা ফেরার পর মঙ্গল নিয়ে আরও গবেষণা হয়। বিজ্ঞানীরা মঙ্গলগ্রহে এখন চাষাবাদের ব্যবস্থা করেছে। তারা সেখানে করেছেন জলের প্রবাহ। বাতাসে অক্সিজেনের পরিমাণ বাড়ানোর টেকনিকও আবিস্কার করেছেন।
রাশিদুল হাসানের যন্ত্র আজ প্রতিটি মহাকাশযানে বসানো হয়েছে। কম জ্বালানী দিয়ে বেশি গতি পাওয়ার কৌশল জেনে গেছে মানুষ। এর ফলে আজ প্লুটোতে পা রাখতে পেরেছে মানুষ। ঘাঁটি করেছে বৃহস্পতির চাঁদে। 
কি দুর্ভাগ্য এখনকার প্রজন্ম এই মহৎপ্রাণ মানুষটির কথা ভুলে গিয়েছে।
অথচ এদের মতো মানুষের আত্মত্যাগের জন্যই আমরা তারার দেশে যাত্রার স্বপ্নকে সত্যে পরিণত করেছিলাম।
যেখানেই থাকো ভালো থেকো বন্ধু।  ”

( জিরো টু ইনফিনিটি নভেম্বর ২০১৩ সংখ্যায় প্রকাশিত) 

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন